কন্যাকে লেখা এক পিতার অসামান্য চিঠি


মা, দেখতে দেখতে তুমি বড় হয়ে যাচ্ছো। কল্পনার চাইতেও দ্রুত গতিতে বড় হচ্ছো। আজ তোমার বয়েস তিন মাস হলো।অথচ, এইতো সেদিন তুমি তোমার মায়ের সাথে অপারেশন রুম থেকে বের হলে।

তুমি তোমার মায়ের পাশে শুয়ে। দরোজায় আমি, আমার পিত্রালয়ের স্বজন, তোমার মায়ের পিত্রালয়ের স্বজন, বন্ধু, পরিচিত সবাই দাঁড়িয়ে, অধীর অপেক্ষায়। নার্স যখন চাকা লাগানো বিছানাটা ঠেলে নিয়ে এলো, তখন তোমার মায়ের পাংশু মুখে বিবর্ণ হাসির চেষ্টা। চোখের কোনে গর্বের দ্যুতি।




আর তুমি, ডাগর চোখ দুটি দিয়ে সবাইকে দেখছো। তুমি কি জানো, তোমার চোখ আর আমার চোখের রং একদম একরকম। একে একে সবার উপর দিয়ে ঘুরে এলো তোমার চোখ। একসময় এসে থামলো আমার চোখে। আমার তখনো হাঁটু কাঁপছে। অনেক চেষ্টা করছি কথা বলতে। কিন্তু অক্ষম গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হচ্ছে না। সবাই তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে, তোমার সাথে সেলফি তুলতে হামলে পড়লো। কিন্তু আমি নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বিভোর হয়ে দেখছি তোমাকে। আমার ভালবাসার মানুষ, তোমার মাকেও এক লহমার জন্য ভুলে গেলাম। শুধু দেখছি আর দেখছি। তুমিও আমাকে দেখছো। এক মুহূর্তের জন্যও নজর সরাওনি। কী করে চিনেছিলে?

তুমি কি জানো, বাইশে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাত আটটায় তুমি আমায় জন্ম দিয়েছিলে। একজন বাবার জন্ম হয়েছিলো সেই মুহূর্তে। আজ আরেক মঙ্গলবার। আরেক বাইশ। তোমাকে এই তিনমাস প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হতে দেখেছি আমি। তুমি প্রতিদিন বড় হচ্ছো, আর আমার চিন্তা বাড়ছে। তুমি এমন এক পৃথিবীতে বড় হচ্ছো, যেখানে আর কদিন পরেই তোমাকে পড়তে হবে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মুখে।

স্কুলে ভর্তির প্রতিযোগিতা। ক্লাসে ফার্স্ট হবার প্রতিযোগিতা। সবাইকে ছাড়িয়ে যাবার প্রতিযোগিতা। নাচ শেখার, গান শেখার, আর্ট শেখার, এক্সট্রা কারিকুলামের প্রতিযোগিতা। একটা লেভেল শেষ হবার আগেই সামনে এসে হাজির হবে নতুন লেভেলের টার্গেট। প্রতিটি লেভেল কঠিনতর হবে আগেরটির চেয়ে। তোমার নাভিশ্বাস উঠে যাবে মা। তোমার সুখ শেষ হয়ে যাবে। এখন যেমন তুমি কুড়ি ঘণ্টা ঘুমাও, আর কদিন পরেই তোমার কুড়ি ঘণ্টা ছুটতে হবে। এই ছোটা তোমার ছোট্ট জীবনটাতে আর কখনো শেষ হবে না। আমি তা চাই না, মা। আমি চাই, ছোট্ট একটুখানি এই জীবনটা তুমি হেসে-খেলে কাটিয়ে দাও। তোমার জীবনটা হোক আনন্দে পূর্ণ। সাফল্য না হয় তোমার জীবনে নাইবা এলো।

গতকালই দেখছিলাম, আমার ফেসবুক ফিড ভরে গেছে আমার বন্ধুদের স্বস্তিমূলক স্ট্যাটাসে। তাদের মেয়েরা ভিকারুন্নেসা স্কুলে চান্স পেয়েছে। ওইসব স্ট্যাটাসে যতটা না ছিল সন্তানের সাফল্যের গর্ব, তার চাইতে বেশী ছিল হাফ ছেড়ে বাঁচবার স্বস্তি। ওই স্ট্যাটাসের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল গত এক বছর ধরে ওই বাবা-মা কতটা মানসিক চাপের পরীক্ষা দিয়েছে। ওই সন্তানটিকে বছর শেষের লক্ষ্যে পৌঁছুতে কি খাটুনিটাই না খাটতে হয়েছে। এই একবছর সে বিকেল দেখেনি। মাঠ দেখেনি। নানীবাড়ি, দাদীবাড়ি দেখেনি। বন্ধু দেখেনি। শুধু দেখেছে, কোচিং, হাউজ টিউটর আর মোটা মোটা ভর্তি গাইড। দু’একদিনের মধ্যে তোমার রাঙ্গাভাইয়েরও স্কুলে ভর্তির ফল আসার কথা। ওদের পরিবারটিও গত দুবছর ধরে কাটাচ্ছে অসহনীয় যন্ত্রণায়।

আমি জানি না, তোমাকে এই দুর্বিপাক থেকে রক্ষা করতে পারবো কি না। সমাজ, পরিজন, প্রিয় মানুষ, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সেটা করতে দেবে কিনা। তাই বলি, তুমি বড় হয়ো না মা। তুমি এতটুকুই থাকো। তুমি আমার বুকের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকো।

ছোট্ট পুটুলি আমার। তুমি কি জানো, তোমার জন্মের আগ থেকেই তোমার মায়ের ফুলে ওঠা পেটের কাছে মুখ নিয়ে তোমাকে পুটুলি পুটুলি ডাকতাম। এখন সবাই তোমাকে ওই নামেই ডাকে। হয়তো একটু বড় হলে এই নামটা নিয়ে অপ্রস্তুত হবে তুমি। আমি তোমাকে আরো কত্ত নামে ডাকি! সেগুলোর কোনওটা ভাল, কোনটা খারাপ। ফুলপরী, মন্টুর মা, বাবু। আর সব পাখির নাম তোমার। সব ফুলের নামও তোমার। কিন্তু তোমার পোশাকি নাম দিয়েছি আরিয়া। আরিয়া তানিয়া হোসেন। আমার বন্ধুদের কেউ তার সন্তানের কাব্যিক নাম রেখেছে। কেউবা ধর্মীয় নাম। আমরা তেমন চাইনি। আমরা চেয়েছি, আমরা যখন থাকবো না, তখন তোমার নামের মাঝে যেন বেঁচে থাকি আমি আর তোমার মা। কিন্তু সবচাইতে বেশী যেটা চাই, তুমি ছোট্টটিই থাকো।

আমি চাইনা তুমি বড় হও, সফল হও, গাড়িঘোড়া চড়। পৃথিবীটা খুবই পুঁতিগন্ধময় এখন। তুমি যতই বড় হবে সেই দুর্গন্ধ তোমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। তোমাকে কপাল কুঁচকাতে শেখাবে, চোখ ছোট করতে শেখাবে, কূট হতে শেখাবে, হিংসা শেখাবে। আর কেড়ে নেবে তোমার হাসি। টোল পড়া হাসি তোমার। তুমি সারাক্ষণ হাসো। কারণেও হাসো, অকারণেও হাসো। তুমি কি জানো, তোমার এক দিদা আছে, হাসি দিদা। তিনিও সারাক্ষণ হাসেন। তোমার নামটা হাসি রাখলেই হতো।
এই হাসি কমে যাক, তোমার চোখ কপাল কুঁচকে থাকুক, আমি কি করে সইবো বলো। আমি তো ঠিক করেছি তোমাকে বেশী পড়াবো না। ছোটখাটো একটা স্কুলে কোনওমতে হাতে খড়ি হবে তোমার। তোমাকেও বিয়েটিয়েও দেবার ইচ্ছে নেই। কিন্তু সেটা কি পারবো শেষ পর্যন্ত? তাই বলি তুমি বড় হয়ো না। এমন ছোট্টটি থাকো, হেসেখেলে ধুলোবালি করে আমাদের সাথে কাটিয়ে দাও ছোট্ট জীবনটি।

তোমার বাবা
২২.১২.২০১৫
Share on Google Plus

About news zone

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment